raabtabd.com

সেই নব্বই দশকের গোড়া থেকে আজ একবিংশ শতাব্দী। কালস্রোতে অনেকদূর ভেসে এসেছি। বয়স কি কম হলো! মানুষকে বলা হয় “a traveller Between life and death” মৃত্যু কখন এসে সামনে দাড়ায় সেই ভাবনায় দিন কাটে। আজ জীবনের পঁচিশ তম বসন্তে দাঁড়িয়ে দেখি আমার অতীত আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, সে ডাক উপেক্ষা করা কঠিন। আমরা বর্তমান নিয়ে বসবাস করছি, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা—কল্পনা করি। পেছনে যা ফেলে আসি তা অতীত। আর যা নিয়ে আমরা কথা বলি তাই হয়ে যায় স্মৃতিচারণ। প্রতিমূহূর্তে আমাদের মৃত্যু হয় আবার প্রতিমূহূর্তে বেঁচে উঠি। এই মৃত সময়গুলোকে একত্র করলে সেটাই হয়ে উঠে স্মৃতি—বিস্মৃতি। জীবনের তিন ভাগের এক ভাগই শেষ, সেহেতু স্মৃতিচারণের জন্য অনেকটাই অতীত আছে আমার। ভোর বেলা ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামলে, হেমন্তের ধূসর বিকেলে একঝাঁক বক আকাশ কাঁপিয়ে উড়ে গেলে কিংবা গ্রীষ্মময় দুপুরে প্রচন্ড রোদে কলাপাতা মড়মড়িয়ে উঠলে আমার বর্তমান যেনো কালবৈশাখী ঝড়ে উড়ে যাওয়া ধূলোর মতো উড়িয়ে নিয়ে যায় আমার ফেলে আসা দিনে। আমি অতীত মনে করতে চাই না। অনেকেই কষ্ট দিয়েছে দুঃখ দিয়েছে, অপে‣ায় বসিয়ে রেখেছে দিনমান। আমি এগুলো ভুলে যেতে চেয়েছি বারবার, কিšদ দুর্ভাগ্যক্রমে আমি অনেক কিছু ভুলি না। তবে স্মৃতি সত্যিই মধুর। স্মৃতির কাছে ফিরলেই পরিস্কার দেখতে পাই আমার ফেলে আসা সরল গ্রাম, নদী প্রান্তর খোলা মাঠ। মাঝে মাঝে ফেলে আসা দিনগুলোতে ফিরে যেতে মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিšদ সময় অ্যাবাউট টার্ন করে না। তাই পেছনের দিন গুলোতে তাকিয়ে স্মৃতির জাবর কেটে পা—পা করে সামনে আগাই। ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে। একান্নবর্তী সংসারে নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনযাপন ছিলো আমাদের। তখন আমাদের একটা প্রজন্ম ছিলো সবাই পিটেপিটি। উম্মাদের মতো আমরা দিকদিগন্তে ছুটে বেড়িয়েছি। বাড়ির পাশের সুরমা নদী সাঁতরে পার হয়েছি। বিরাট বিরাট মাঠ ঘুরে বেড়িয়েছি, সদলবলে গুলতি নিয়ে পাখির খুঁজে দিন কাটিয়েছি। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আমাদের শৈশবের চমৎকার দিনগুলোর কথা ভাবতেই পারবে না। অপরূপ ধানে—গানে ভরা গ্রাম শৈশব পাওয়া শেষ প্রজন্ম মনে হয় আমরাই ছিলাম। শৈশবে আমাদের গ্রামের অদূরে একটা বট গাছ ছিলো,তার ছায়ার নিচে মেলা বসতো প্রতি বৈশাখে।লোকেরা বলতো বান্নি। তার পাশে ছিলো একটা ভাঙ্গা মন্দির, সবাই বলতো এখানে ভূত—প্রেত আছে। খবরদার! কেউ যাবেনা। গা ছমছম করতে করতে তবু্ও গেছি। কিছু নেই, ভীষণ নির্জনতা ছাড়া। গ্রামের উত্তরে একটা দিঘি ছিলো, প্রচুর লালপন্স ফুটতো। আমরা দঙ্গল ছেলেরা দু’দলে ভাগ হয়ে এপার ওপার থেকে কাঁদা ছুড়াছুঁড়ি খেলতাম। এক সময় চোখ রক্তজবার মতো টকটকে লাল করে ভয়ে ভয়ে ঘরে ফিরতাম। আমাদের তখন একটা থিওরি ছিলো, নাম না জানা একটা পাতা আছে। সে পাতা বগলের নিচে বা পাতা খেলে চোখের লাল আভাটা কমে যায়,আমরা সে পাতা চিবুতে চিবুতে ঘরে ফিরতাম, তবে কাজ কতটুকু হতো বুঝতে না পারলেও পাতার উপর আমাদের বিশ্বাস ছিলো। আমাদের দুরন্তপনায় বিরক্ত হয়ে গ্রামের লোকজন বলতো পন্স দিঘিতে বিশাল কুন্ডলী আছে। মানুষ টানে। আমি হাবলা টাইপের হলেও সাহসী ছিলাম। একদিন লম্বা শ্বাস নিয়ে ডুব দিলাম। যতই নিচের দিকে এগুতে লাগলাম ততই ঠান্ডা পানি। যত নিচে নামছি তত ঠান্ডা বাড়ছে হিম ঠান্ডা। একেবারে তলায় গিয়ে দেখি কাদা। মুঠোভরে কাদা তুলে এনে প্রতিযোগিতা শুরু করি। প্রাইমারীতে পড়াকালীন ইশকুল পালাতাম খুব। কখনো বাড়ি থেকে ইশকুলের নাম নিয়ে বেড়িয়ে রাখালদের সাথে গরু চড়াতে চলে যেতাম। বর্ষায় জাম পাকতো, তিন চার ঘন্টা গাছেই কাটিয়ে দিতাম। পেট ভরে জাম খেয়ে সুর্য যখন মধ্যাকাশ থেকে হেলে পড়তো তখন গাছ থেকে নেমে বাড়ি ফিরতাম। মা ভাবতেন স্কুল থেকে ফিরছি। আমাদের শৈশবে সবচেয়ে বেশি মজা হতো ঈদ এলে। রোযা শেষের দিকে চলে এলে ঈদের কাপড় কিনে লুকিয়ে রাখতাম কাউকে দেখাতাম না। ঈদের সকালে সবাই মিলে হৈ—হুল্লা শুরু হতো পুকুরঘাটে। তারপর বের করতাম ঈদের পোশাক। কার পোশাক কতটুকু তা নিয়ে আনন্দের প্রতিযোগিতা হতো। ঈদুল আজহার দিন আমরা গরুর হাড্ডি জমিয়ে রাখতাম। বিকেলে সেগুলো বাড়ির পেছনের জঙ্গলে নিয়ে যেতাম। হাড্ডি গুলো রশি দিয়ে এমন ভাবে বেঁধে লটকিয়ে রাখতাম। যাতে সহজে ছুঁতে না পারা যায়। তারপর আমরা অবস্থান নিতাম খানিক দুরত্বের ঝেঁাপের আড়ালে, খেলা জমতো তখন। মাংসের গন্ধ পেয়ে গর্ত থেকে বেড়িয়ে আসতো শেয়াল। হাড্ডি ছুঁয়ার জন্য কি যে লম্ফঝম্প। একেকটার পাগলের মতো অবস্থা হতো। আমরা ঝেঁাপের আড়ালে বসে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতাম। এরকম হাজারো স্মৃতি আছে শৈশবের। আমরা দুরন্ত ছিলাম।তবে কারো ‣তি করিনি কোনদিন । হিন্দু মুসলিম সবার সাথে আমাদের আন্তরিকতা ব্যাপক ছিল। তারপর একটু বড়ো হলাম যখন, গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসলাম। একা চলতে শিখে গেছি তখন। কেমন শান্তশিষ্ট হয়ে গেলাম। তার মূলে ছিলো পড়াশোনা আর মা বাবার কড়া শাসন। তখন আর পড়াশোনায় ফাঁকি দেই নি। প্রতিদিন ইশকুলে যেতাম। শেষবার যখন গ্রামে যাই তখন অনেক কিছু পাল্টে গেছে।কুপী হারিকেনের বদলে গ্রামে এসেছি ইলেক্ট্রিসিটি, ছনে ছাওয়া ঘরের জায়গায় আধপাকা টিনসেড ঘর। বন কেটে উজাড় সব। শৈশব স্মৃতি হিসেবে কেবল ঠিকে আছে ইশকুল ঘরের পাশে বাজ পড়া খেজুর গাছটা। ছোটবেলায় চাঁদনী রাতে গাছ দুটুকে মনে হতো বিশাল দৈত্য বুঝি তার দুপা মাটিতে রেখে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *