raabtabd.com

দেশ ছেড়ে ইউরোপে পারি দিয়েছি বছর দুয়েকের একটু বেশি হবে । এ সময়টাতে অনেক রকমের মানুষ দেখেছি, কেউ আস্তিক কেউ বা নাস্তিক, কারো গায়ের রঙ সাদা কেউ বা একটু ঘোলাটে রঙের । কেউ বেশ সুখে আছে কারো বা জীবনে দুঃখের অন্ত নেই । সব মিলিয়েই তো জীবন- কিন্তু এসব কিছুর ঊর্ধ্বে আরও একটা জিনিস আছে যেটাকে আপনি উপেক্ষা করতে পারবেন না, যদি আপনি বিশ্বাসী হয়ে থাকেন । তা হলো- ধর্ম ।
আমার মনে হয় এখানে বসবাসরত লোকজন, বিশেষ করে বাঙালিরা ইসলাম আর ইউরোপিয়ান সভ্যতাকে এক সুতোয় গাঁথতে গিয়ে বেশ হজবরল একটা পরিস্থিতি বানিয়ে ফেলেছে । তারা ক্রিসমাস নাকি ঈদ কোনটাকে বেশি প্রাধান্য দেয়া উচিত এ নিয়ে দ্বিধায় ভোগে । সমাজ বলে ক্রিসমাস আর আত্মা বলে ঈদ, স্কুলে বাচ্চাদেরকে শেখানো হয় ঈসা আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়েছে আর বাসায় এসে তারা জানে তাকে আল্লাহ নিজের কাছে রেখেছেন । এই যে ইসলাম আর ক্রিশ্চিয়ানিজমের দ্বন্দে তারা ছোট বেলা থেকেই বড় হয় এইগুলো শিশুর মস্তিকে ভালো কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না । আবার কখনও কখনও সে তাঁর পরিবারের কারো কাছ থেকেও এসবের সুস্পষ্ট কোনো উত্তর পায় না । আর কাউকে যদি পারিবারিকভাবে ইসলামের সাধারন জ্ঞানটুকু দেয়া না যায়, বড় হওয়ার পর তাঁর জন্য ইসলামকে নিজের মধ্যে ধারন করা বেশ কষ্টসাধ্য । আমি বলছিনা অসম্ভব, হেদায়েত আল্লাহর হাতে তিনি যাকে ইচ্ছা সেই নূর দ্বারা নূরান্বিত করে থাকেন । তবে বাচ্চাদের জন্য ইসলামের প্রাথমিক শিক্ষাটা পরিবার থেকেই হওয়া উচিত । কিন্তু এখানে অমন খুব একটা হয় বলে আমি অন্তত মনে করি না । বাবা-মায়েরা অপেক্ষায় থাকেন একজন হুজুরের, যিনি এসে তাদের সন্তানকে জান্নাতের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যাবেন । কিন্তু আদতে কি এটা সম্ভব!
এখানকার বাচ্চারা সপ্তাহে ছুটি পায় দুই দিন, শনিবার ও রবিবার । এই দুইদিনই মূলত তারা ধর্মীয় জ্ঞান শেখার পেছনে ব্যয় করে । কেউ মসজিদে যায়, আবার কারো বাসায় হুজুর যান পড়াতে । আর সন্তান মোটামুটি কোরআন শরিফ পড়তে পারা মানেই হচ্ছে তাঁর দ্বীন শিক্ষা সমাপ্ত । মানে এখানে ইসলামী জ্ঞানের চূড়ান্ত পর্যায় হচ্ছে, কোনোমতে কোরআন শরিফ পড়তে পারা । ধরে নিচ্ছি দশ বছর বয়সে একটা ছেলে কোরআন শরিফ সমাপ্ত করলো, কিন্তু এরপর পরিবার থেকে তাকে আর মসজিদে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়া হলো না অথবা বাসার হুজুরকে বিদায় করে দেয়া হলো । কিন্তু তাঁর কাছ থেকে কিন্তু এখানকার কথিত ইউরোপীয়ান সভ্যতা তারা দূর করতে পারেনি, বরং জীবনের পুরোটা সময় সে এই সভ্যতার বেড়াজালে থেকেই পার করবে । তাহলে তার জন্য কি অতটুকু দ্বীন শিক্ষা যথেষ্ঠ হতে পারে? আমি বলবো না । বরং এখানে দ্বীন শেখার বা শেখানোর প্রক্রিয়াটাকে আরও দীর্ঘ করা উচিত, সাথে প্রতিটা বাবা-মায়ের আরও সচেতন হওয়া উচিত ।
সন্তানকে দ্বীনের জন্য উৎসাহিত করা বা সে জন্যে চাপ প্রয়োগ করার ব্যাপারটা পরে- এখানকার বাঙালি পিতা-মাতা কতটা ধর্মকর্মে মনোযোগী! যতদূর আমি দেখেছি বেশিরভাগ ফ্যামিলিই ধর্মের ব্যাপারে যথেষ্ঠ উদাসীন । মোটামুটি মানের ধর্মভীরু খৃষ্টানরাও এখানে সপ্তাহে অন্তত একদিন নিয়ম করে গির্জায় যায়, আর উতসবের দিনে তো লোকাল বাসগুলোতে জায়গা পাওয়া মুশকিল । মানে তারা বেশ জোরেশোরে তাদের ধর্মীয় দিন/উতসবগুলি পালন করে থাকে । কিন্তু ঈদের দিনেও অনেক বাঙালি পুরুষকে দেখেছি যারা ঈদের নামাজ বাদ দিয়ে কাজে যাচ্ছে । জুমআ তো অনেক দূরের কথা । প্রায় সবাই নামাজের ব্যাপারে উদাসীন । ৯-১১ বছর বয়সী অনেক ছেলেকেই দেখেছি যারা শুক্রবারের নামাজ তথা জুমার নামাজের সাথে পরিচিত না । হুট করে জিজ্ঞেস করলে হা করে তাকিয়ে থাকে । এর অন্যতম কারন তাদের বাবা । মাসের প্রতিটি জুমা আদায় করেছেন এমন মুসল্লি খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর । আর এছাড়াও বাচ্চাদের স্কুল থাকে তাই শুক্রবারে মসজিদে বিশেষ কোনো নামাজ হয়ে থাকে, নিয়ে তারা খুব একটা মাথা ঘামায় না ।
কিছুদিন আগে পার্শ্ববর্তী এক শহরের স্কুলে মুসলমান স্টুডেন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় স্কুল কতৃপক্ষ পুরো প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছিলো ঈদ উপলক্ষ্যে । আমি সেটা শুনে আমাদের মসজিদে এক জুমায় প্রস্তাব করেছিলাম সকলে মিলে স্কুলের সাথে আলাপ করে শুক্রবারে জুমার সময় অন্তত আধা ঘন্টার একটা বিরতির ব্যবস্থা করতে, যাতে বাচ্চারা নামাজে আসতে পারে কিন্তু আজঅব্দি কেউ দ্বিতীয়বার সেই প্রসঙ্গ তুলেনি । ছেলে-মেয়েদেরকে স্কুলের হোমওয়ার্ক করানোর জন্য আফটার স্কুল প্রোগ্রাম, বাসায় হোম টিউটর রাখাসহ কত আয়োজন । অথচ এক লাইন আরবি সবক ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো হুজুরকে পড়ে শোনাতে পারে না কারন সারা সপ্তাহে তারা আরবি বই ছুঁয়েও দেখেনি । এদিকে মসজিদের হুজুরকে বারবার প্রেশার দেয়া হয় কেনো তাদের সন্তানরা খুব অল্প সময়ে কোরআন নিতে পারছে না!
আমাদের শহরটা খুব বেশি বড় না, সবমিলিয়ে প্রায় ১৫টি মসজিদ আছে এখানে কিন্তু দিনের বেশিরভাগ ওয়াক্তের নামাজই ইমাম সাহেব একা অথবা ২/৩জন মুসল্লি নিয়ে আদায় করেন ।
ইউরোপে ইসলাম আবারও বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে কিন্তু সেই অনুযায়ী মানুষের জীবনে ইসলাম প্রভাব সেরকমভাবে ফুটে উঠছে বলে আমি মনে করি না । মানুষ সার্বক্ষনিক হারামের মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে এখন আর হালাল কষ্ট করে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে না । তারা শুধুমাত্র সরাসরি এলকোহল- মদ, শূকর এগুলো থেকে বেঁচে থাকে । কিন্তু সন্তানের জন্য কিনে আনা চকলেট, কেক, জুস থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির নিত্য প্রয়োজনীয় বিশেষকরে গরু কিংবা মুরগীর মাংস জবাইকৃত পশুর কি না, সেসব আর যাচাই করে দেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না । ফলশ্রুতিতে নিজেদের অসাবধানতার কারনে দিনের পর দিন হারাম খেয়ে যাচ্ছে তারা । কাউকে বলে দিলে উত্তর দেয়, কত আর খুঁজে খুঁজে খাওয়া যায় । ইসলাম কি এতই কঠিন, আল্লাহ কি আমাদের পরিস্থিতি দেখছেন না! ‘
এ জন্যই বোধহয় বলা হয় যে, আল্লাহর রহমতের দিকে তাকিয়ে এত বেশী গোনাহে লীপ্ত হয়ো না যে আল্লাহ তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন । আল্লাহ পৃথিবীর মুসলমানদের সহায় হোন ।
তবুও দিনশেষে আশা একটাই- ইউরোপে আবারও ইসলামী বিপ্লব ঘটুক, মসজিদগুলো থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসুক, মুছে যাক সব পাপ পঙ্কিলতা, নতুন করে গড়ে উঠুক আমাদের আল হামরা ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *